ফুলবাড়ীতে দাদন ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে ২৫ জন বাড়িছাড়া

‘মোহাম্মদ আলী (দাদন ব্যবসায়ী) মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে ভয় দেখায়; বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে, ঘরের টিন ও গরু নিয়ে যেতে চায়। খারাপ কথা বলে। তার ভয়ে স্বামী ঘরছাড়া হয়েছে। দুই সন্তান নিয়ে অর্ধাহারে থাকতে হয়। স্বামীর খোঁজও পাচ্ছি না।’ কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই পশ্চিমপাড়া গ্রামের আবদুল হকের স্ত্রী আফতারুন খাতুন। শুধু আবদুল হকই নন, দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পেরে বাড়িছাড়া হয়েছেন এই ইউনিয়নের তিন-চারটি গ্রামের অন্তত ২৫ ব্যক্তি। দাদন ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে তাঁরা বাড়ি ছেড়েছেন। সরেজমিনে ঘুরে এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, বারাই পশ্চিমপাড়া গ্রামের আবদুল হক ওই এলাকার হঠাৎপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে সাড়ে তিন বছর আগে চড়া সুদে ২০ হাজার টাকা দাদন নেন। টাকা পরিশোধ করতে না পেরে তিন বছর আগে তিনি পালিয়ে যান। আবদুল হকের বাবা শরফুদ্দিন আলী (৭০) বলেন, ‘মোহাম্মদ আলী ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বারাইহাট বাজারে আমার ছেলের কাছে পাওনা টাকা আমার কাছে দাবি করে। দুই-এক কথা বলতেই সে পায়ের জুতা খুলে আমাকে মারে। এ ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় লোকজন বারাইহাট বাজারে ১৭ অক্টোবর অর্ধদিবস হরতাল ও বিক্ষোভ করেন।’
বারাইহাট বাজারের বাসিন্দা মজিবর রহমান, মোহাম্মদ আলী, কেদার মেম্বার ও নকুল চন্দ্র বলেন, সুদখোরদের দাপটে এলাকার নিরীহ মানুষজন দিশেহারা। সুদের টাকা দিতে গিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। সুদখোরদের দাপটে এলাকার প্রায় ২৫ ব্যক্তি বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
এলাকাবাসী জানান, মোহাম্মদ আলী, লাল্টু, মোফাজ্জল, আনারুল (ভুট্টু), সেকেন্দার, রজব আলী, চন্দন চৌধুরীসহ একটি চক্র উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাইহাট ও পার্শ্ববর্তী কালিরহাট এলাকায় চড়া সুদের দাদন ব্যবসা গড়ে তুলেছে।
আলাদীপুর ইউনিয়নের কাশিনাথপুরের আদিবাসী বুদু মুরমু বলেন, সেকেন্দারের কাছ থেকে ৫০০ টাকা দাদন নিয়ে এক বছরে সাত হাজার টাকা দিতে হয়েছে। সময়মতো টাকা দিতে না পারায় মারধরও করা হয়েছে। একই গ্রামের হরিলাল হাসদা জানান, মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সময়মতো দিতে না পারায় ১৬ অক্টোবর বাজারের মধ্যে তিনি তাঁকে বেদম মারধর করেছেন।
সোম হাসদা (৮০) বলেন, তাঁর ছেলে কমল হাসদা মোহাম্মদ ও মোফাজ্জলের কাছ থেকে টাকা দাদন নিয়েছিলেন। টাকা দিতে না পারায় তাঁরা কমলকে মারধর করেছেন। পরে তিনি ভয়ে পালিয়ে গেছেন। এ ছাড়া বারাই পশ্চিমপাড়া গ্রামের ছাইদুল, মজিদ ও আনোয়ার; হঠাৎপাড়া গ্রামের সহিদুল, মোসলেম ও দুলু; চেয়ারম্যানপাড়ার পাতারু, মোস্তাকিম, আমিনুল হক ও জিয়ারুল এবং বারাই গ্রামের প্রমোদ চন্দ্রসহ সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ জন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেছেন।
গত বুধবার দুপুরে উল্লিখিত দাদন ব্যবসায়ীদের প্রত্যেকের বাড়িতে গেলে শুধু সেকেন্দার আলীকে পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন, মানুষের উপকারের জন্য এ ব্যবসা করেন। পাওনা টাকার জন্য নির্যাতনের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী মোসলেমা বলেন, তাঁর স্বামীর দাদন ব্যবসা এবং দাদনের টাকা আদায়ের জন্য নির্যাতনের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। মোফাজ্জলের স্ত্রী শাহানাজ খাতুনের দাবি, তাঁর স্বামী দাদনের ব্যবসা করেন না। ভুট্টুর বাবা ইসমাইল হোসেন (৮২) বলেন, ‘ছেলেকে অনেক নিষেধ করেছি; শোনে না। মানুষের পাল্লায় পড়ে সে সুদের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে।’
আলাদীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাফফর হোসেন বলেন, বারাইহাট এলাকায় দাদন ব্যবসায়ীদের একটি চক্র গড়ে উঠেছে। তাদের অত্যাচারে তিনজন আদিবাসী গ্রাম ছেড়েছেন। দাদন ব্যবসায়ীদের ভয়ে আরও বেশ কিছু লোক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে তিনি শুনেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, দাদন দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। তবে দাদন ব্যবসায়ীদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 সূত্রঃ প্রথম আলো, প্রকাশঃ ২৫-১০-২০১০